May 18, 2024, 6:20 am

পাঁচ সিটিতে নির্বাচন

পাঁচ সিটিতে নির্বাচন: প্রার্থী চূড়ান্তের পরও স্পষ্ট অভ্যন্তরীণ বিরোধ

Spread the love

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের বড় শহরগুলোর এই ভোট নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারছে না দলটি। কারণ পাঁচ সিটির মধ্যে চারটিতেই অভ্যন্তরীণ বিরোধ স্পষ্ট। দলের প্রার্থীর পক্ষে এখনো ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামেননি মনোনয়নবঞ্চিতরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন সংশয়ে। কোথাও কোথাও পক্ষে বিপক্ষে মিছিলও হচ্ছে। ফলে নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত এবং তাদের অনুসারীদের নৌকার পক্ষে মাঠে নামানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, যারা মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা এবং বিতর্কমুক্ত কি-না সেটা বিবেচনা করেই প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। শুরুতে কিছুটা বিভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবাই দলের সিদ্ধান্ত মেনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন।

জানা যায়, গাজীপুরে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পরেও নির্বাচনি মাঠে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে মাঠে নেই ডাবলু সরকার ও তার অনুসারীরা। সিলেটে মনোনয়নবঞ্চিতরা আনোয়ারুজ্জামানকে সহযোগিতা করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বরিশালে মেয়র প্রার্থীর পক্ষে হয়েছে মিছিল, শোডাউন। করা হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। তবে পাঁচ সিটির মধ্যে সবচেয়ে নির্ভার আছেন খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান যুগান্তরকে বলেন, যোগ্যতা, দক্ষতা, জনপ্রিয়তা এবং বিভিন্ন জরিপ বিবেচনায় নিয়ে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তৈরি হয়। মনোনয়নপ্রত্যাশীও বেশি থাকে। এটা খারাপ কিছু নয়। আমরা তাদের বুঝিয়ে বসানোর চেষ্টা করি। ফলে মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও দলের সিদ্ধান্তের পর বেশির ভাগই বসে যান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে থেকে যান। কারণ আমরা তো কাউকে নির্বাচন করতে বাধা দিতে পারি না।

বড় চিন্তা গাজীপুর নিয়ে : গাজীপুর সিটির তৃতীয় নির্বাচনে আজমত উল্লাহ খানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সিটিতে দলটির মনোনয়ন চেয়ে ১৭ জন ফরম কিনেছিলেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলের প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে মাঠে নামানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক দিকে গাজীপুর আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটাই প্রকাশ্যে। অন্য দিকে কেন্দ্র থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে জাহাঙ্গীর আলমসহ আরও দু-এক প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি মাঠে থেকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মহানগরে আমার বিপুলসংখ্যক কর্মী ও সমর্থক রয়েছে। আমি ভোটারদের কাছে যাব। তারা যদি মনে করেন আমার নির্বাচন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তাহলে ভেবে দেখব।’

জানা যায়, ২০১৩ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনের সময় মনোনয়ন নিয়ে আজমত উল্লাহ খান ও জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে দ্বৈরথ শুরু হয়। জাহাঙ্গীরের বিরোধেই আজমত উল্লাহ পরাজিত হন, এমন কথাও বলেছিলেন অনেকে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দলেও। ২০১৫ সালে আজমত উল্লাহ খান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এতে মহানগর আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরে আলাদা ও পালটাপালটি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

লিটনের পাশে নেই ডাবলু : রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আবার দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। লিটনকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মিছিল হয়েছে। মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রোববার বিকালে নগরীর রানীবাজারস্থ এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি মিছিলটি বের হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে এসে শেষ হয়। তবে মহানগর আওয়ামী লীগের মিছিল হলেও সেই মিছিলে ছিলেন না কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও সহসভাপতি মাহফুজুল আলম। তারা দুজনই রাজশাহী সিটি নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এর আগে মনোনয়ন পাওয়ার পর শনিবার দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন খায়রুজ্জামান লিটন। সেখানেও উপস্থিত ছিলেন না ডাবলু সরকার ও মাহফুজুল আলম।

এছাড়া ডাবলু সরকারের বোন জামাই রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর ইকবাল, ডাবলুর ভাগনে এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন; ডাবলুর ভাই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকারও ছিলেন না মহানগর আওয়ামী লীগের মিছিলে।

জানা যায়, রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন ও ডাবলু সরকারের বিরোধ এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে। সম্প্রতি গণভবনে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ডাবলু সরকার খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। এবারের নির্বাচনে লিটন মনোনয়ন পাচ্ছেন এটা মোটামুটি সবার জানা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে লিটনও জানিয়েছিলেন গ্রিন সিগন্যালের কথা। তবুও ডাবলু মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। ফলে এই নির্বাচনে ডাবলু দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে সরে যাবেন কিনা; আবার ভোটের মাঠ থেকে সরলেও দলীয় প্রার্থী লিটনের পক্ষে কতটা সক্রিয়ভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে।

সিলেটে এখনো সংশয় : আনোয়ারুজ্জামান সিসিক নির্বাচনে মেয়র হিসাবে মনোনয়ন পেতে পারেন দলের এমন গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে মাঠে নামার পরও সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র কোনো নেতাকে পাশে পাননি। যদিও জেলা ও মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা আনোয়ারুজ্জামানের পাশে রয়েছেন শুরু থেকেই। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এই নেতাকে ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে ১০ জন নৌকার মাঝি হতে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ঘোষণা ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের যে কাউকে মনোনয়ন দিলে তাকে জয়ী করতে এক হয়ে কাজ করবেন সবাই। কিন্তু আনোয়ারুজ্জামানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর পরই গুমোট একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে স্থানীয় রাজনীতিতে। যদিও মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতাই দলের হাই কমান্ডের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তবে আদৌ তারা মন থেকে আনোয়ারুজ্জামানকে সহযোগিতা করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

বরিশালে ঐক্যের চ্যালেঞ্জ : বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। দলীয় মনোনয়নের এই ঘোষণার পরপরই মাঠে নামেন সাদিক বিরোধীরা। খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে নগরে পৃথক আনন্দ মিছিল হয়। মোটরসাইকেল মহড়াও হয়। চলে মিষ্টি বিতরণ। এসব মিছিল আর মহড়ায় যোগ দেয় সদর আসনের সংসদ-সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিমের অনুসারীরা। অন্যদিকে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ মনোনয়ন না পাওয়ায় তার নেতা-কর্মীরা নিরাশ হয়েছেন। বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা চুপচাপ আছেন, কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন না।

এদিকে চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের ব্যাপারে ভাতিজা সাদিক আবদুল্লাহর মনোভাব এখনো পরিষ্কার নয়। খোকনের পক্ষে নির্বাচনি মাঠে সাদিক বা তার অনুসারীরা কতটা আন্তরিকভাবে নামবেন, তা পরিষ্কার নয়। এখন সব পক্ষের নেতাকর্মীদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামানোই বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের। দলীয় একটি সূত্র জানায়, বরিশালের রাজনীতিতে এতদিন প্রকাশ্যে গ্রুপিং খুব একটা চোখে পড়েনি। কিন্তু এবার মেয়র প্রার্থী পরিবর্তনের পরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। সরাসরি কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই নির্বাচনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে রাখা সম্ভব হবে না।

নির্ভার খালেক : খুলনা সিটি নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। পাঁচ সিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্ভার দলটির এই প্রার্থী। চারজন মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্তের পর তার পক্ষেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। এদিকে খালেকের মনোনয়ন পাওয়ার পর শনিবার খুলনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খুশির আমেজ বিরাজ করে। কেসিসি নির্বাচনে ২০০৮, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে খালেক আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হলেও ২০১৩ সালে বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।

এবার নির্বাচনে খালেকের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তালুকদার আবদুল খালেক খুলনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তথা খুলনাবাসীর আশা-ভরসার প্রতীক। তার হাত ধরেই খুলনা একটা আধুনিক নগরীতে পরিণত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মাঝে সেবা পৌঁছে দিতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করছেন। এজন্য কেন্দ্রীয় নেতারা যোগ্য প্রার্থী হিসাবে তাকে চূড়ান্ত করেছেন।

সুত্র: যুগান্তর


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category